যেভাবে ঘটে বিবর্তন

সুপারসনিক গতিতে বিবর্তন বিষয়ক তিন তিনটা নোট লিখে ফেললাম এবং যতটুকু আশা করেছিলাম তার চেয়ে ঢের বেশি সাড়া পেলাম বন্ধুদের কাছ থেকে (লাইক দেখে অবশ্যই সেটা বিচার করা যাবে না 😛 )। অতঃপর নিয়মিত তথা প্রতিটা নোটই পড়ে কিংবা নিদেনপক্ষে চেখে দেখেছেন, এমন পাঠককুলের একজন সেদিন এমন এক অদ্ভূত প্রশ্ন করে বসলো যে ভাবতে বাধ্য হলাম নোটগুলো আদৌ বোধগম্য হয়েছে কিনা। কেননা, যে বিবর্তনবাদকে উপজীব্য করে নোটগুলো লেখা, সেই বিবর্তন কীভাবে ঘটে, সেটাই পুরোপুরি পরিষ্কার না অনেকের কাছে। তাই ভাবলাম বিবর্তন ঘটার মেকানিজম নিয়েই একটা নোট লিখে ফেলি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বিবর্তন তত্ত্বের ব্যপ্তি এত বিশাল যে একটা নোট দিয়ে এর পুরোটা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা সম্ভব না। বিবর্তনবাদ সম্বন্ধে জানার জন্য অ্যাকাডেমিক বইয়ের কোন বিকল্প নেই। নোটটি লিখতে আমি যে বইয়ের সাহায্য নিয়েছি, সেটাও এরকম একটা বই (রেফারেন্স দ্রষ্টব্য)। এছাড়াও এটার মতো ইন্টারনেটে বেশ কিছু অ্যাকাডেমিক সাইট আছে যেগুলো থেকে বিবর্তন কীভাবে ঘটে, সে বিষয়ে সম্যক ধারণা পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া বাংলায়ও বেশ কিছু তথ্যবহুল লেখা রয়েছে যেগুলো পড়ে দেখলে বিবর্তনের কন্সেপ্টটা স্বচ্ছ হয়ে যাবে। কেবল বিবর্তনবাদ বিষয়ক লেখার সংকলন নিয়েই মুক্তমনায় একটা আলাদা পেজ আছে যেটাতে সবগুলো লেখা কেউ পড়ুক আর না পড়ুক, জীবনে অন্তত একবার ঢু মেরে আসা সকল বাঙালির অবশ্য কর্তব্য বলে আমি মনে করি। যাহোক, পাঠককে এতসব রিসোর্স ধরিয়ে দিয়ে কেটে পড়লে আসলে দায় সম্পন্ন হয় না। এ কারণেই লিখতে বসা।

===========================================

নিজে কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র, পাঠকদের মধ্যে বন্ধুতালিকার সহপাঠীরাই বেশি বলে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মডেলেই বিবর্তনের পদ্ধতিটা ব্যাখ্যা করি। নিজের ব্যাখ্যা বললে ভুল হবে, এটা আসলে ড্যানিয়েল ডেনেটের বর্ণিত ইভল্যুশনারি অ্যালগরিদমঃ

১. প্রকৃতিতে যতটি বেঁচে থাকতে সক্ষম, প্রতিটি জীবই তার চেয়ে বেশি সংখ্যক সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে।

২. যেগুলো সক্ষম, ওরা বেঁচে থাকে এ কারণেই যে, যেখানে ওরা থাকে, সেখানকার প্রকৃতির সঙ্গে ওরা ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারে।

৩. প্রকৃতি সতত পরিবর্তনশীল।

এ তিনটি স্টেটমেন্টকে এবার একটা ইনফিনাইট লুপে ফেলে দিলে অনেকগুলো ইটারেশনের পর দেখা যাবে, শুরুতে জীবগুলো যেমন ছিলো, প্রকৃতি পরিবর্তিত হবার ফলে তাতে মানিয়ে নিতে ওরাও বদলে গেছে। কী? কঠিন লাগছে? এবার নাহয় একটু সোজা করেই বলি। সমস্যা হচ্ছে, সোজা করে বলতে গেলে এ নিয়ে বিশাল একটা প্যাচাল পাড়তে হবে। তাই এবার এক বুক নিশ্বাস নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসুন, প্যাচাল শুরু হচ্ছে এখনই।

১. প্রতিটা জীব যে সংখ্যক সন্তান জন্ম দেয়, প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে সেগুলো পুঃনরায় সন্তান জন্মদানের আগেই তার বড় একটা অংশ প্রকৃতিতে টিকে থাকার সংগ্রামে হেরে যায়। উদাহরণ হিসেবে মুক্তমনা ব্লগার অভিজিৎ রায়ের লেখা থেকে নিচের উদ্ধৃতিটা দ্রষ্টব্যঃ

একটা পুরোপুরি বড় হওয়া কড মাছ বছরে প্রায় ২০ থেকে ৫০ লাখ ডিম পাড়ে, একটি মেপল বা আম বা জাম গাছে হাজার হাজার ফুল এবং ফল ধরে, কিন্তু এর বেশীরভাগই পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করার আগেই মৃত্যুবরণ করে, আমাদের দেশের ইলিশ মাছের কথাই চিন্তা করে দেখুন না। সমুদ্র থেকে নদীগুলোতে এসে তারা কি হারে ডিম পারে আর তাদের মধ্যে ক’টাই বা শেষ পর্যন্ত পুর্ণাঙ্গ মাছে পরিণত হয়ে টিকে থাকতে পারে! বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে একটা কড মাছের ডিমের ৯৯% ই প্রথম মাসেই কোন না কোন ভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, বাকি যা বেঁচে থাকে তার প্রায় ৯০% জীবনের প্রথম বছরেই কোন না কোনভাবে মৃত্যুবরণ করে। ডারউইনও তার বইয়ে এই একই জিনিস দেখিয়েছেন হাতীর বংশবৃদ্ধির উদাহরণ দিয়ে। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় হাতীর বংশবৃদ্ধির হার তুলনামুলকভাবে খুবই কম, কিন্তু তারপরও একটা হাতী তার জীবনে যে ক’টা বাচ্চার জন্ম দেয় তার মধ্যেও সবগুলি শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে না। ডারউইন হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, হাতী অন্য সব প্রাণীর তুলনায় সবচেয়ে কম বংশবৃদ্ধি করেও তার ৯০-১০০ বছরের জীবনে প্রায় ৬ টি বাচ্চার জন্ম দিতে পারে। অর্থাৎ যদি সবগুলো বাচ্চা বেঁচে থাকে তাহলে এক জোড়া হাতী থেকে ৭০০-৭৫০ বছরে প্রায় ১৯০ লক্ষ হাতীর জন্ম হবে । … একটা ব্যকটেরিয়া প্রতি ২০ মিনিটে বিভক্ত হয়ে দুটো ব্যকটেরিয়ায় পরিণত হয়, হিসেব করে দেখা গেছে যে এরা সবাই বেঁচে থাকলে এক বছরে তারা বংশ বৃদ্ধি করে সারা পৃথিবী আড়াই ফুট উচু করে ঢেকে দিতে পারতো। একটা ঝিনুক কিংবা কাছিম একবারে লাখ লাখ ডিম ছাড়ে, একটা অর্কিড প্রায় ১০ লাখ বীজ তৈরী করতে পারে।

২. দ্বিতীয় স্টেটমেন্টটি ভাঙলে বেশ কয়েকটি বিষয় চলে আসেঃ

ক) বংশগতি (heredity): সন্তান জন্মদানের সঙ্গে সরাসরি যে ব্যাপারটি এসে পড়ে, সেটা হচ্ছে বংশগতি। একটি জীব থেকে আরেকটি জন্মানোর সময় অপত্যটি তার আগেরগুলো থেকে জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল লাভ করে, অর্থাৎ, বাবা-মা’র মধ্যে যে শারীরিক-মানসিক বংশগতীয় বৈশিষ্ট্যগুলো (genetic traits) থাকে, সন্তানের মধ্যেও সেগুলো যায়। সন্তানেরা তাদের কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী অ্যালিল (allele)* পায় বাবার ডিএনএ’র কিছু অংশ থেকে, আর কিছু পায় মায়ের থেকে। এসব নিয়ে আগে কিছু ছাইপাঁশ লিখেছিলাম, পড়ে দেখতে পারেন।

খ) প্রকরণ (variation): সন্তানদের প্রত্যেকের ডিএনএ অর্ধেক তৈরি হয় বাবার কাছ থেকে পাওয়া অর্ধেক ডিএনএ থেকে, আর বাকি অর্ধেক মায়ের থেকে। এক্ষেত্রে সব সন্তান বাবা ও মায়ের সব বৈশিষ্ট্য একই সঙ্গে পেতে পারে না, ফলে বৈশিষ্ট্যগুলো সন্তানদের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে সন্তানদের নিজেদের মধ্যেও কিছু পার্থক্য বা প্রকরণ থাকে।

বাবা-মায়ের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো আছে, কেবল সেগুলোই যে পরের প্রজন্মে সঞ্চারিত হবে, তা নয়। কখনো কখনো বাবা বা মায়ের কোন কোন বৈশিষ্ট্য একটু বদলে গিয়ে সন্তানের মধ্যে প্রকাশিত হতে পারে। মিউটেশন, জিন ডুপ্লিকেশন ইত্যাদি বেশ কিছু ঘটনা ঘটে যেতে পারে যে কোন জীবের ডিএনএ-তেই। এতে করে নতুন অ্যালিল তৈরি হয় যার ফলে ওই জীবের মধ্যে বাবা বা মায়ের যে বৈশিষ্ট্যটি থাকার কথা, সেটি সামান্য পরিবর্তিত হতে পারে। এভাবে এমনকি বাবা ছাড়াই যেসব প্রাণী – যেমনঃ পার্থেনোজেনেটিক জীব – বাচ্চা জন্ম দিতে পারে, তাদের মধ্যেও নতুন ভ্যারিয়েশন তৈরি হয়।

গ) ফিটনেস (fitness): ভ্যারিয়েশন প্রতিফলিত হয় বিভিন্ন জীবের স্ব স্ব প্রজনন সাফল্যের (reproductive success) মধ্যে। ভ্যারিয়েশন থাকায় সবাই সমান হারে সন্তান জন্ম দিতে পারে না। কোন জীব যে পরিমান সন্তান জন্ম দেয়, সেটাই ঐ জীবের প্রজনন সাফল্য। সাফল্য বেশি হওয়া মানে জীবটি অধিক হারে সন্তান জন্ম দিতে পারে। এই সাফল্য নির্ভর করবে যে বৈশিষ্ট্যের কারণে জীবটি অধিক হারে বংশবৃদ্ধি করতে পারছে তার উপর। যেমনঃ দ্রুতগামী শিকার ধরার জন্য শিকারীকে দ্রুততর হতে হবে। এক্ষেত্রে মাংশপেশী ও হাড়ের বিশেষ গঠনের কারণে যদি কোন শিকারী আরো জোরে দৌঁড়াতে পারে, তাহলে সেটা তার বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধির জন্য বাড়তি সহায়ক হবে, অর্থাৎ, সে তখন তার পপুলেশনের অন্য জীবদের চেয়ে বেশি সংখ্যক সন্তান জন্ম দিতে পারবে। বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধিতে দরকারী এ বৈশিষ্ট্যগুলোর সাফল্যই হচ্ছে ঐ বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য দায়ী অ্যালিলের ফিটনেস। ফিটনেস বেশি হলে ঐ অ্যালিলের জন্য যে বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশিত হয়, সেটা জীবটিকে প্রকৃতিতে টিকে থাকা ও সন্তান উৎপাদন করতে বাড়তি সুবিধা দেয়।

ঘ) নির্বাচন (selection): প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে টিকতে অনেকগুলো প্যারামিটার প্রয়োজন। বিভিন্ন জীবের ক্ষেত্রে এগুলো বিভিন্ন। যেমনঃ বাঁচার জন্য খাবার খেতে হয়। খাবার সংগ্রহ ও খাওয়ার ধরন বিভিন্ন প্রাণীর বিভিন্ন রকম। শিকারী প্রাণীকে খাবারের জন্য শিকার করতে হয়। এ শিকার ধরার জন্য আবার প্রয়োজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ভালো ঘ্রাণ ও শ্রবণশক্তি, শারীরিক শক্তিমত্তা, ক্ষিপ্রতা ইত্যাদি। অন্যদিকে যে শিকার, ওর বেঁচে থাকার জন্য দরকার হয় বাড়তি সতর্কতা, যেখানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ঘ্রাণশক্তি ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে শিকারীর চোখকে ফাঁকি দিতে ক্যামোফ্লাজ (camouflage) এর মতো বৈশিষ্ট্যেরও দরকার হতে পারে। ভ্যারিয়েশন থাকায় এ বৈশিষ্ট্যগুলো সবার একইরকম হয় না। যাদের ফিটনেস বেশি, ওরা শিকার ধরতে বা শিকারীর কবল থেকে বাঁচতে অধিকতর সফল হয়। ফলে ওদের বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। বংশবৃদ্ধির সময় পরের প্রজন্মে এ বৈশিষ্ট্যগুলোই বংশগতীয়ভাবে সঞ্চারিত হয়। অন্যদিকে যারা সফল হয় না, ওরা মারা যায়, নয়ত ওদের সন্তান-সন্ততি কম হয় এবং যেগুলো হয়, ওদের মধ্যে বাবা-মা’র দুর্বল বৈশিষ্ট্যগুলোই সঞ্চারিত হয়। পরের প্রজন্মে গিয়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং সফলরাই অধিক হারে সন্তান-সন্ততি রেখে যায়। প্রকৃতি এভাবে একরকম ছাঁকন প্রক্রিয়ার মতো করেই ওর সবচেয়ে যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের বেছে নেয়। এটাকে বলা হয় সিলেকশন বা নির্বাচন। সিলেকশনের মাধ্যমে প্রকৃতিতে খাপ খেতে সাহায্যকারী বৈশিষ্ট্যগুলি প্রজন্মান্তরে জীবদের মধ্যে বিকশিত ও পুঞ্জীভূত হতে থাকে। একটু ব্যাখ্যায় যাওয়া যাক।

সন্তানদের মধ্যে ভ্যারিয়েশন থাকায় যে অ্যালিলগুলো সবচেয়ে বেশি ফিট, তার সবগুলোই সব সন্তানের মধ্যে সমানভাবে থাকে না। যে সন্তানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অপেক্ষাকৃত অধিক ফিট অ্যালিলগুলো থাকবে, ওরা বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধির কাজটা অন্যদের চেয়ে কিছুটা ভালোভাবে করতে পারবে। এভাবে পুরো প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে। এর ফলে যে বৈশিষ্ট্যগুলো জীবের কোন উপকারে আসে না, সেগুলো তথা ওগুলোর সংশ্লিষ্ট অ্যালিল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটু একটু করে হারিয়ে যাবে। অন্যদিকে যেগুলো বাড়তি উপযোগিতা দেবে, সেগুলো পরের প্রজন্মগুলোর মধ্যে আরো ঘন ঘন দেখা যাবে। এভাবে বিভিন্ন উপকারী অ্যালিল ও তার সংশ্লিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জীবদের মধ্যে সংকলিত হতে থাকবে, অর্থাৎ, পরের প্রজন্মগুলোর জীবরা বান্ডল আকারে একই সাথে বিভিন্ন উপকারী বৈশিষ্ট্যসমেত জন্ম নিতে থাকবে।

৩. প্রকৃতি সতত পরিবর্তনশীল। একসময় যেটা ছিল অজস্র বৃক্ষে আচ্ছাদিত ঘন জঙ্গল, আজ হয়ত সেটা বিরান মরুদ্যান। একটা সময় যে অঞ্চল সারা বছরই বরফে ঢাকা থাকত, সেখানেই আজ প্রচণ্ড খরতাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত। প্রকৃতির এ পরিবর্তন একদিন দুইদিনের নয়, লক্ষ-কোটি বছরের অত্যন্ত ধীর পরিবর্তন। আজকের জীব আজকের পরিবেশে টিকে থাকার জন্য অভিযোজিত। তাহলে আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগেকার জীব সে পরিবেশে কীভাবে টিকে ছিল? আবার লক্ষ বছর পরের পরিবেশেই বা এরা টিকবে কীভাবে? এতক্ষণ ধরে যা বললাম, তাতেই এর উত্তর পেয়ে যাবেন। বোঝার সুবিধার্থে পুরো প্রক্রিয়াটার একটা সারমর্ম দাঁড় করালে ব্যাপারটা হয় এরকমঃ প্রতিটা জীব বাচ্চা জন্ম দেয়। বাচ্চার মধ্যে বাবা-মা’র বৈশিষ্ট্যগুলো সঞ্চারিত হয়। বাচ্চাগুলোর মধ্যে ভ্যারিয়েশন থাকে। এ ভ্যারিয়েশন তৈরি হয় মিউটেশনের মাধ্যমে। যে ভ্যারিয়্যান্টগুলো বেশি সফল, ওগুলো টেকে, বাকিগুলো মারা যায়। টিকে যাওয়াগুলো আবার বাচ্চার জন্ম দেয় এবং আগের প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। প্রকৃতি যদি এখন পরিবর্তিতও হয়, তবু অ্যালগরিদম ফলো করলে এ পরিবর্তিত প্রকৃতির সঙ্গেও জীবগুলো মানিয়ে নিতে পারে। এ মানিয়ে নেয়ার জন্য জীবের পপুলেশনে যে পরিবর্তনগুলো হয়, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে প্রজন্মান্তরে সেগুলোই পুঞ্জীভূত হয়ে যে বিশাল পরিবর্তন সাধন করে, তার ফলেই নতুন প্রজাতির** উদ্ভব হয়।

প্রকৃতির পরিবর্তনও হয় কখনো দ্রুত, কখনো ধীরে। এ পরিবর্তন জীবের জীবনধারণ ও প্রজননে যে প্রভাব ফেলে, তাকে বলে সিলেকশন প্রেশার। সিলেকশন প্রেশারে হেরফের হলে জীবের ফিটনেসে পরিবর্তন হয়। ফলে কোন কোন বৈশিষ্ট্যের ফিটনেস বাড়ে বা কমে এবং সিলেকশনের মাধ্যমে সেগুলো পরের প্রজন্মে বেশি করে সঞ্চারিত হয় কিংবা হারিয়ে যায়। প্রকৃতি দ্রুত পরিবর্তিত হলে তাতে খাপ খেতে জীবদের কিছুটা হিমশিম খেতে হয়, কেননা, অমন পরিবেশে টেকার মতো বৈশিষ্ট্যগুলো হয়তো তখনো জীবটার পপুলেশনে অতটা ঘন (common) হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে বলা যায় সিলেকশন প্রেশার অনেক বেশি। উল্টোটা, অর্থাৎ, পরিবর্তন ধীর হলে সেক্ষেত্রে সিলেকশন প্রেশার হবে কম। সিলেকশন প্রেশার বেশি থাকলে বিবর্তনও দ্রুত হয়। অন্যথায় হয় অনেক ধীর।

নিচের ছবিটা দিয়ে ভ্যারিয়েশন সৃষ্টি এবং সিলেকশনের মাধ্যমে কীভাবে বিবর্তন ঘটে সেটার একটা সরল ডায়াগ্রাম দেখানো হয়েছেঃ

 Image

একদম উপরে দেখা যাচ্ছে মাঝামাঝি গাঢ়ত্বের একটা বৃত্ত থেকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গাঢ়ত্বের বৃত্ত বেরিয়ে এসেছে। বৃত্তগুলো দিয়ে এখানে যেকোন একটা বৈশিষ্ট্যকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। মিউটেশনের ফলে আগের বৈশিষ্ট্যটিই বদলে দুটি নতুন ভ্যারিয়েশন তৈরি হয়েছে যার মধ্যে একদম বামের সাদাটি ক্ষতিকর বলে বৈশিষ্ট্যটি পরের প্রজন্ম পর্যন্ত উৎড়াতে পারে নি। বাকি দুটোর ফিটনেস একই বলে মিউটেশনের ফলে প্রতিটি থেকেই দুইটি করে পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে। এরপর যে দুইটির ফিটনেস অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল, ওরা অন্য দুইটিকে হটিয়ে পরের প্রজন্মে নিজদের কপি তৈরি করেছে। গাঢ়টির ফিটনেস বেশি বলে পরের প্রজন্মে ওটা বেশি কপি তৈরি করতে পেরেছে। একেবারে উপরেরটার সঙ্গে এবার একদম নিচের পাঁচটির গাঢ়ত্ব মিলিয়ে দেখুন, পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় কি? 

এটা আসলে খুবই সরলিকৃত একটা ডায়াগ্রাম যেখানে প্রতি প্রজন্মেই মিউটেশনের ফলে নতুন ভ্যারিয়েশন তৈরি হচ্ছে। মিউটেশন কার্যত খুব বিরল একটা ঘটনা। তবু যেটা ঘটে, লক্ষ-কোটি জীবের একেকটা পপুলেশনে তার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এ বিরল মিউটেশনের ফলে যত অল্প হাতেগোনা ভ্যারিয়েশনই তৈরি হোক না কেন, সিলেকশনের মাধ্যমে যেগুলো বেশি সফল, ওগুলোই পরের প্রজন্মগুলোর জীবের মধ্যে একত্রিত হতে থাকবে। হাজার হাজার প্রজন্মের পর জিনপুলে (gene pool) একসময় ওই অ্যালিলগুলোই রাজত্ব করবে।

সংক্ষেপে এই হচ্ছে বিবর্তন সংঘটনের তত্ত্ব, চার্লস ডারউইন যেটার নাম দিয়েছিলেন “প্রাকৃতিক নির্বাচন”। এটা কোন র‍্যান্ডম মেকানিজম নয়, নানারকম ভ্যারিয়েশন থাকা একদল জীবের উপর নির্দিষ্ট সিলেকশন প্রেশার তৈরি করলে তাতে খাপ খাইয়ে নিতে ওরা একটা নির্দিষ্ট গতিপথে বদলাবেই। বিবর্তনের আরেকটা মেকানিজম হচ্ছে “জেনেটিক ড্রিফ্‌ট”। এটা কিছুটা র‍্যান্ডম বা দৈবাৎ। এক্ষেত্রে সিলেকশন প্রেশার না থাকা সত্ত্বেও স্রেফ দুর্ঘটনার ফলে কোন কোন বৈশিষ্ট্য পরের প্রজন্মে অধিক হারে সঞ্চারিত হতে পারে। এছাড়া মানুষের হস্তক্ষেপেও বিবর্তন ঘটতে পারে। কোন জীবের উপর মানুষ কর্তৃক সিলেকশন প্রেশার তৈরি করার মাধ্যমে ঘটা এ বিবর্তনকে বলা হয় “আর্টিফিশিয়াল সিলেকশন”। হাজার হাজার বছর ধরে সংকরায়ন বা ব্রিডিং-এর মাধ্যমে নতুন জাত ও প্রজাতির ফসল ফলানোর যে প্রক্রিয়াটা চলে আসছে, এটাই আর্টিফিশিয়াল সিলেকশন। দশ হাজার বছরের আর্টিফিশিয়াল সিলেকশনের মাধ্যমেই নেকড়ে থেকে এসেছে আজকের কুকুর। প্রাণীদের মধ্যে এরকম নজির আরো আছে – বিভিন্ন জাতের পায়রা, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী, মাছ …… হাপিয়ে গেছি, বাকিগুলো নিজে বের করুন। 😛

===========================================

ফুটনোটঃ

* অ্যালিল – অ্যালিল হচ্ছে একই জিনের বিভিন্ন রূপ বা ভ্যারিয়েশন। জিন হচ্ছে ডিএনএ’র অংশ যেটা জীবের একটা নির্দিষ্ট্য বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী। যেমনঃ গায়ের রং। অ্যালিলগুলো হচ্ছে জিনের বিভিন্ন ভ্যারিয়েশন যেগুলোর কারণে একটা বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন প্রকরণ হয়। যেমনঃ গায়ের রঙের বিভিন্নতা। সিলেকশন প্রেশার প্রয়োগ করলে কোন জীবের জিনপুলে কোন বৈশিষ্ট্যের অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সির (allele frequency) যে পরিবর্তন হয়, সেটাই বিবর্তন।

** প্রজাতি – প্রজাতি হচ্ছে কতগুলো জীবের সমন্বয়ে একেকটা গোষ্ঠী যারা নিজেদের মধ্যে প্রজননের মাধ্যমে টিকে থাকতে সক্ষম (viable) এবং উর্বর (fertile) সন্তান জন্ম দিতে পারে কিন্তু অন্য গোষ্ঠীর জীবের সঙ্গে প্রজননে অক্ষম। যেমনঃ ঘোড়ার সঙ্গে ঘোড়ার প্রজননে ঘোড়ার জন্ম হয়। তেমনি গাধার সঙ্গে গাধা। এরা কেউ চাইলে কুকুরের সঙ্গে প্রজনন করতে পারে, তবে বাচ্চা হবে না, কেননা এরা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির। ঘোড়া ও গাধার প্রজননে কখনো কখনো খচ্চর জন্মায়, তবে ওরা অনুর্বর, অর্থাৎ, প্রজননে অক্ষম। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, পৃথিবীর সব মানুষই এক প্রজাতির অন্তর্গত। সুতরাং, কাউকে অন্য প্রজাতির মানুষ বললে ভুল হবে, বায়োলজিক্যালি স্পিকিং।

তথ্যসুত্রঃ

১। Evolution by Douglas J. Futuyma, 1st Edition

২। উইকিপেডিয়া

One response to “যেভাবে ঘটে বিবর্তন”

  1. […] লিখতে চাচ্ছি না, কারো ইচ্ছে হলে আগের এ লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন। মন, কনশাসনেস […]

Leave a comment

Blog at WordPress.com.